গড অব ক্রিকেট' খ্যাত শচীন টেন্ডুলকার নব্বই দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তার ব্যাটিং যাদুতে বুঁদ করে রেখেছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। শতকের পর শতক আর অর্ধশতক হাকিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন পূর্বের অনেক রেকর্ড। টেস্ট ক্রিকেট অথবা ওয়ানডে সবখানেই তিনি ছিলেন সমান উজ্জ্বল। ভারতীয় কিংবদন্তী ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তখন ক্রিকেটবোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমী সকলেই ধরে নিয়েছিল তার অনন্য রেকর্ডগুলো ভাঙার সামর্থ্য কারো নেই; তার কাছাকাছি রানও আর কেউ কখনো করতে পারবে না! মন্তব্যকারীরা তখনো জানতো না আরেকজন ভারতীয় ক্রিকেটে রাজত্ব করতে আসছে যিনি তার ব্যাটিং যাদু দিয়ে শাসন করবে পুরো ক্রিকেট দুনিয়া! তার নাম বিরাট কোহলি, ভারতীয় জাতীয় দলের প্রাণভোমরা, কিংবদন্তি ক্রিকেটার, যিনি এখনো ভারতীয় দলের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে খেলে চলছেন। কিছুদিন আগেই শচীন টেন্ডুলকারের ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটি তিনি ভেঙ্গে দিয়েছেন। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ৫০টি সেঞ্চুরির মালিক বিরাট কোহলি শচীন টেন্ডুলকারের চেয়ে ১৭১টি ম্যাচ কম খেলেই এই রেকর্ড করেছেন।
বিরাট কোহলিকে ক্রিকেট মহলে "দ্যা কিং" নামে সম্বোধন করা হয়। কঠোর মানসিকতা, ধৈর্য আর ব্যাটিং টেকনিকের কারণে ৩৫ বছর বয়সেও দলের মূল ব্যাটিং ভরসা তিনি। তাকে "চেইজ মাস্টার" নামেও অভিহিত করা হয়। পরে ব্যাটিং করে অনেক অসম্ভব ম্যাচকেও তিনি সাবলীল ভাবে জিতিয়ে দিয়েছেন। রান চেজ করা যেখানে সবসময়ই কঠিন সেখানে পরে ব্যাট করে সব ধরনের ক্রিকেটে কোহলির গড় ৬৫।
কে সেরা ব্যাটসম্যান; শচীন টেন্ডুলকার না বিরাট কোহলি?
ক্রিকেট মহলে শচীন টেন্ডুলকার নাকি বিরাট কোহলি কে সেরা এরকম একটা বিতর্ক আছে! খেলার মাঠ থেকে চায়ের কাপ, মাঝে মাঝে বিতর্কটা মিডিয়াতেও চলে আসে। কে সেরা এই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়া হয় ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছেও। সাধারণ ক্রিকেট ফ্যানরা ঝট করে একজনকে সেরা বানিয়ে দিলেও প্রাক্তন ক্রিকেটার বা ক্রিকেট বিশ্লেষকরা এ ধরনের প্রশ্নে মন্তব্য করতে বিব্রত বোধ করেন করেন, মাঝে মাঝে বিরক্তও হন। তাদের দুজনের মধ্যে তুলনা করে সহজেই একজনকে জিতিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই! প্রথমত তারা ভিন্ন সময়ের দুজন ক্রিকেটার, দ্বিতীয়ত বিরাট কোহলি এখনো খেলছেন; অবসর নেয়া পর্যন্ত তার ব্যাটিং পরিসংখ্যান কি হবে তা সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়। বলা যায় শচীনের যেখানে শেষ ঠিক সেখান থেকেই কোহলির শুরু। দুজনেই ২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন। জাতীয় দলের হয়ে একসাথে কিছু ম্যাচও খেলেছেন তারা। দুই কিংবদন্তির সাথে তুলনা করার আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের রানের পরিসংখ্যানটা একটু দেখে নেয়া যাক।
শচীন ও কোহলির টেস্ট ক্যারিয়ারঃ
প্লেয়ার |
ম্যাচ |
রান |
সর্বোচ্চ |
গড় |
শতক |
অর্ধ-শতক |
শচীন |
২০০ |
১৫৯২১ |
২৪৮ |
৫৩.৭৮ |
৫১ |
৬৮ |
কোহলি |
১১৩ |
৮৮৪৮ |
২৫৪ |
৫৯.১৫ |
২৯ |
৩০ |
শচীন ও কোহলির ওয়ানডে ক্যারিয়ারঃ
প্লেয়ার |
ম্যাচ |
রান |
সর্বোচ্চ |
গড় |
শতক |
অর্ধ-শতক |
শচীন |
৪৬৩ |
১৮৪২৬ |
২০০ |
৪৪.৮৩ |
৪৯ |
৯৬ |
কোহলি |
২৯২ |
১৩৮৪৮ |
১৮৩ |
৫৮.৬৭ |
৫০ |
৭ |
দুজনের রানের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ওডিআই ও টেস্ট দুই ফরম্যাট মিলিয়ে মোট রানের হিসেবে শচীন টেন্ডুলকার এখনো বেশ এগিয়ে! টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে শচীনের মোট রান যেখানে ৩৪৩৪৭ সেখানে বিরাট কোহলির রান ২২৬৯৬। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তুলনাটা করা যাবে না কারণ শচীন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন মাত্র একটি। অন্যদিকে কোহলির টি-টুয়েন্টি রেকর্ড ঈর্ষণীয়! ১১৭টি টি-টুয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫১ গড় আর ১৩৮ স্ট্রাইক রেটে চার হাজারের উপরে রান তার; করেছেন ১টি সেঞ্চুরি ও ৩৭টি হাফ সেঞ্চুরি। ৩৫ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার হয়ত আরো কয়েক বছর ভারতীয় দলের হয়ে খেলবেন কিন্তু বয়স, ফিটনেস, ফর্ম সবকিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতে রানের এই ধারাবাহিকতা একই রকম থাকবে কিনা স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্নটা এসেই যায়! মাঝের কিছুটা সময় কোহলির ব্যাটে কিছুটা রান খরা ছিল; দুই বছর দেখা পাননি কোনো সেঞ্চুরির! অন্যদিকে ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া শচীনের দীর্ঘ ২৪ বছরের ক্যারিয়ার। ইনজুরি বা অফ ফর্মের কারণে দীর্ঘ সময় তার ব্যাট হাসেনি এরকমটা দেখা যায়নি খুব একটা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরেও এই দুই ক্রিকেটার সমানভাবে উজ্জ্বল। শচীন লিস্ট-এ ক্রিকেট খেলেছেন ৫৫১টি, রান করেছেন ২১৯৯৯, গড় ৪৫.৫; সেঞ্চুরি ৬০টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ১১৪টি। অপর দিকে ৩১৩টি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলে ৫৭.৪৮ গড়ে কোহলির রান ১৫২৯০, সেঞ্চুরি ৫৪টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ৮০টি। শচীন ৯৬টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ খেলে ৩২.৯০ গড়ে রান করেছেন ২৭৯৭, সেঞ্চুরি ১টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৬টি। অপর দিকে ৩৮৯টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ৪২.০৪ গড়ে কোহলি রান করেছেন ১২৬৫৫। সেঞ্চুরি করেছেন ৯টি আর হাফ সেঞ্চুরি ৯৬টি। দুজনে আবার আন্তর্জাতিক ম্যাচে টুকিটাকি বলও করেছেন। শচীন ওয়ানডেতে ১৫৪ উইকেট, টেস্টে ৪৬ উইকেট ও আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ১টি উইকেট নিয়েছেন। কোহলি ওয়ানডেতে ৫ উইকেট, আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ৪ উইকেট পেলেও টেস্ট ম্যাচে কোন উইকেট নিতে পারেন নি। দুজনের মধ্যে ফিল্ডিংয়েরও একটা পরিসংখ্যান দাঁড় করানো যেতে পারে! শচীন টেস্টে ১১৫টি, ওয়ানডেতে ১৪০টি ক্যাচ ধরেছেন। অপর দিকে কোহলি টেস্টে ১১১টি, ওডিআই ম্যাচে ১৫১টি এবং আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টিতে ৫৮টি ক্যাচ ধরেছেন।
শচীন ও কোহলির মধ্যে কে সেরা এই ধরনের বিব্রতকর প্রশ্ন সাংবাদিকরা মাঝে মাঝে তাদেরকেই করে বসে! শচীনকে একবার তাদের মধ্যে কে সেরা এরকম প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন "কোহলি নিঃসন্দেহে এই প্রজন্মের এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু এক প্রজন্মের খেলোয়াড়ের সাথে আরেক প্রজন্মের খেলোয়াড়ের তুলনা করা ঠিক না।" মজার ছলে তিনি আরো বলেন " আমাদের দুজনকেই একই দলে রেখে দিলে সমস্যা কোথায়?" অন্যদিকে বিরাট কোহলিকে এ ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দেন! শচীনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে তিনি বলেন, " শচীন টেন্ডুলকার ও ভিভ রিচার্ডস নিজেদের সময়ের সেরা ক্রিকেটার, তাদের সাথে কারো তুলনা চলে না। আমি ছোটবেলায় তার খেলা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। লিটল মাস্টার এ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা; তার দক্ষতার সামনে আমরা দাঁড়াতেই পারবো না। উনি সর্বকালের সেরা একজন কমপ্লিট ব্যাটসম্যান।"
শচীন টেন্ডুলকার ও বিরাট কোহলির মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে প্রাক্তন ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বোদ্ধাদের কেউ কেউ বিরাট কোহলিকে কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখলেও সার্বিক বিবেচনায় বেশির ভাগ মন্তব্যকারী শচীন কেন বেটার সেটার ব্যাখাই দিয়ে থাকেন। দুজনের মধ্যে তুলনা করার আগে কিছু ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ এসে যায়। বর্তমানে ক্রিকেট খেলার নিয়ম কানুনে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যাটিং সহায়ক পিচ, ছোট বাউন্ডারি লাইন, ফিল্ডিং ও বোলিং রেস্ট্রিকশন, রিভিউ পদ্ধতি এই সমস্ত কারণে আধুনিক ক্রিকেট ব্যাটিং উপযোগী বেশি। বোলারদের চেয়ে ব্যাটসম্যানরা বেশি সুবিধা পেয়ে থাকে। আবার ক্রিকেটে বাণিজ্যিকীকরণ বেড়ে যাওয়ার ফলে বিজ্ঞাপন দাতাদের ডিমান্ডের কারণেও ম্যাচগুলোতে হাই-স্কোরিং উপযোগী করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারণ বেশি রান মানে বেশি উত্তেজনা, বেশি দর্শক, বেশি লাভ!
আজকে কোহলিরা ব্যাটিং করার সময় যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে আগে শচীনরা বা তারও আগে ভিভ রিচার্ডরা সেই সুবিধাগুলো পেতেন না। শচীনকে তার ক্যারিয়ারে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, অ্যালেন ডোনাল্ড, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়ালসদের মত ফাস্ট বোলার মোকাবেলা করে রান করতে হয়েছে। তখন ঘনঘন বাউন্স, রিভার্স সুইং, ইনসুইং ইয়র্কার এ ধরনের বোলিং অস্ত্রগুলো মোকাবেলা করে ক্রিজে টিকে থাকতে হতো! সেই সাথে শেন ওয়ার্ন, মুরালিধরনদের মত স্পিনারদের মোকাবেলা করতে হতো যারা বল ১৭ ইঞ্চি বাক খাইয়ে বোল্ড করতে পারতো। এখনকার ক্রিকেটে আগের মত এত বিধ্বংসী বোলার নেই! থাকলেও নিয়মকানুনের কারণে তাদের সেভাবে পারফর্মেন্স করার সুযোগ নেই। এ সমস্ত কারণে দুজন ভিন্ন সময়ের ব্যাটারের মধ্যে সরাসরি তুলনা করা ঠিক না। শচীন টেন্ডুলকার এবং বিরাট কোহলি দুজনেই নিজেদের সময়ে এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। একজনকে আরেকজনের চেয়ে সেরা না বলে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল দুটি নক্ষত্র বলা যায়!
0 মন্তব্যসমূহ