Header Ads Widget

Ticker

6/recent/ticker-posts

ক্রিকেটে বৃষ্টি আইন বা ডিএলএস পদ্ধতি কীভাবে ব্যবহার করা হয়?

ক্রিকেট বৃষ্টি আইন ডিএলএস মেথড

বৃষ্টিকে বলা হয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শত্রু! বৃষ্টিতে ফুটবলের মত অন্যান্য বেশ কিছু খেলা পরিচালনা করা গেলেও ক্রিকেটে সামান্য গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতেই খেলা বন্ধ রাখতে হয়। খেলার শুরুতে অথবা খেলা চলাকালীন সময়ে ভারী বৃষ্টি হলে মাঠ পুরোপুরি না শুকানো পর্যন্ত দীর্ঘসময় খেলা বন্ধ থাকে। ভেজা পিচ ও আউটফিল্ডে ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং সবকিছুই কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় ওভার কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পুনঃনির্ধারণ করে খেলা শুরু করতে হয়। বৃষ্টির কারণে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়া ক্রিকেট একটি সাধারণ ঘটনা

পূর্বে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বেশ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পদ্ধতিগুলোর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে বর্তমানে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে সঠিক ও নির্ভুল হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যায়।

সাউথ আফ্রিকার বৃষ্টি আইন ট্র্যাজেডীঃ

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রবর্তনের পূর্বে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাটা ঘটে সাউথ আফ্রিকার সাথে! ১৯৯২ সালে সিডনীতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বৃষ্টিবিঘ্নিত ৪৫ ওভারের ম্যাচে ইংল্যান্ডের দেয়া ২৫২ রানের টার্গেটে সাউথ আফ্রিকা ৪২.৫ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৩২ রান তোলার পর শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টির পর সাউথ আফ্রিকার জন্য পরিবর্তিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ১ বলে ২১ রান। ক্রিজে থাকা দুইজন সেট ব্যাটসম্যান নিয়ে জয়ের সম্ভাবনায় থাকা ম্যাচটি ১৯ রানে হেরে যায় সাউথ আফ্রিকা! তখন বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ফলাফল আনার জন্য MPO যার পুরো অর্থ Most Produtive over মেথড ব্যবহার করা হতো। এই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ইনিংসে বৃষ্টির কারণে যে কয় ওভার খেলা বন্ধ থাকতো সেই ওভারগুলো কমিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হতো। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে প্রথমে ব্যাট করা দলের সবচেয়ে কম রান তোলা ওভারগুলো বিবেচনা করা হতো! যেমন দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ ওভার খেলা বন্ধ থাকলে প্রথম ইনিংসে যে ৫ ওভার সবচেয়ে কম রান এসেছে সেই ওভারগুলোর মোট রান কমিয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হতো। ৯২ এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এই পদ্ধতির কারণেই সাউথ আফ্রিকার ম্যাচ জেতা অসম্ভব হয়ে উঠে। অথচ ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখা যায় ১ বলে ৪ রান করলেই ম্যাচ ড্র হতো এবং ৫ রান করলেই সাউথ আফ্রিকা ম্যাচটি জিতে যেতো।   ঐ ম্যাচ এবং লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তখন প্রচুর সমালোচনা হয়।

ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতি কী?

ওয়ানডে এবং টি-টুয়েন্টি ম্যাচে বৃষ্টি বিঘ্নতার কারণে বা আলোক স্বল্পতার কারণে ওভার, রান ও উইকেটের সঠিক হিসাব-নিকাশের ব্যবহার করে পরে ব্যাট করা দলকে যে পরিবর্তিত লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় সেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পদ্ধতিকে ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড বলা হয়। ইংলিশ পরিসংখ্যানবিদ ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ ও গণিতবিদ টনি লুইস পূর্বে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে ১৯৯৭ সালে এই পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। ১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ড-জিম্বাবুয়ের মধ্যকার একদিনের ম্যাচে সর্বপ্রথম পদ্ধতিটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। উক্ত ম্যাচে জিম্বাবুয়ে ডি/এল মেথডে ৭ রানে জয়ী হয়। পরবর্তীতে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি ১৯৯৯ সালে পদ্ধতিটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে এর ব্যবহার শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ান অধ্যাপক স্টিভেন স্টার্ন পরবর্তীতে ডি/এল মেথডকে আরোও নির্ভুলভাবে সংস্কার করেন। ২০১৪ সাল থেকে পদ্ধতিটির নাম পরিবর্তন করে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন বা সংক্ষেপে ডি-এল-এস মেথড নামে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়?

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য বেশ কিছু জটিল গাণিতিক চার্ট ব্যবহার করা হয়। সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগী ছাড়াও অনেক ক্রিকেটাররাও হিসেব-নিকাশটি বুঝতে পারেনা। ইন্ডিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক মোহেন্দ্র সিং ধোনি একবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, "আমি ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি বুঝি না; আমি শুধু আম্পায়ারের সিধ্যান্তের জন্য অপেক্ষা করি!" ধোনির মত অনেকের কাছেই ডিএলএস মেথড এক গোলক ধাঁধার নাম। তবে ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ ও টনি লুইস মিলে পদ্ধতিটির বিস্তারিত বর্ণনা ৭৬ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে লিখে রেখে গেছেন! তাদের দেখানো সূত্র ধরে খুব সহজেই এবং অল্প সময়ে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এখন খুব সহজ।

ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে "এ্যাভাইলেভেল রিসোর্স" নামে একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর কোনো দলের কত রান হয়েছে, কত ওভার বাকি আছে এবং কত উইকেট হাতে আছে তার ভিত্তিতে এ্যাভাইলেভেল রিসোর্স পরিমাপ করা হয়। বৃষ্টির কারণে খেলার পূর্বেই ওভার নষ্ট হলে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। তখন দুই ইনিংসে থেকে কিছু ওভার কমিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রথম ইনিংসে বৃষ্টির কারণে ওভার কমানো হলে অথবা প্রথম ইনিংসে পুরোটা খেলা হলে এবং দ্বিতীয় ইনিংস চলাকালীন সময়ে বৃষ্টির কারণে ওভার নষ্ট হলে ডি-এল-এস মেথড ব্যবহার করে পুনরায় টার্গেট নির্ধারণ করা হয়।

DLS Available Resource Calculator
কাল্পনিক একটা ম্যাচের মাধ্যমে ডিএলএস মেথডের গাণিতিক চার্টের ব্যবহার করে লক্ষ মাত্রা নির্ধারণের চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৬০ রান তুললো । পরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ২০ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ১০০ রান তোলার পরে বৃষ্টি শুরু হলো। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে যেহেতু বৃষ্টি হয়নি তাই তাদের এ্যাভাইলেবেল রিসোর্স ১০০%। আর বাংলাদেশের ইনিংসের যেহেতু এখনো ৩০ ওভার বাকি এবং হাতে ৮টি উইকেট রয়েছে তাই ছবির চার্ট অনুযায়ী এই মুহূর্তে বাংলাদেশের এ্যাভাইলেবেল রিসোর্স ৬৭.৩%।

ধরা যাক বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ থাকার কারণে বাংলাদেশের ইনিংস থেকে ১০ ওভার কাটা পরলো। তাহলে বাংলাদেশের হাতে রইলো ৩০-১০= ২০ ওভার। ওভার কাটা যাওয়ার পর ছবি অনুযায়ী এই মুহূর্তে ২০ ওভারে বাংলাদেশের এ্যাভাইলেবেল রিসোর্স হবে ৫২.৪%। খেলা বন্ধ হওয়ার সময় রিসোর্স ছিল ৬৭.৩%। রিসোর্সের পার্থক্য ৬৭.৩% - ৫২.৪% = ১৪.৯%। তাহলে ১০০% থেকে এই ১৪.৯% বিয়োগ দিলে হাতে থাকবে ৮৫.১%। এটাই হলো বাংলাদেশের বর্তমান এ্যভাইলেবেল রিসোর্স।

এখন অস্ট্রেলিয়ার ১০০% এ্যভাইলেবেল রিসোর্সের সাথে আমরা বাংলাদেশের পরিবর্তিত ৮৫.১% এ্যভাইলেবেল রিসোর্স বের করে ফেলেছি। এখন একটি সমীকরণের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই বাংলাদেশের জন্য নতুন লক্ষ মাত্রা বের করে ফেলতে পারবো। সমীকরণটি হলো; বাংলাদেশের এ্যভাইলেবেল রিসোর্স ভাগ অস্ট্রেলিয়ার এ্যভাইলেবেল রিসোর্স গুন অস্ট্রেলিয়ার মোট রান যোগ ১। অর্থাৎ ৮৫.১ ভাগ ১০০ গুন ২৬০ + ১= ২২১.২৬ = ২২২ রান হবে বাংলাদেশ দলের নতুন টার্গেট। যেহেতু বাংলাদেশ ২০ ওভারে ১০০ রান তুলে ফেলেছে তাই বাকী ২০ ওভারে ২২২-১০০ = ১২২ রান করলেই ম্যাচে জয়লাভ করবে!

এভাবে এ্যভাইলেবেল রিসোর্সের চার্ট ও সমীকরণের ব্যবহার করে খুব সহজেই বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ওভার ক্যালকুলেশন করে ম্যাচের নতুন লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করা যায়। এমনকি প্রথম ইনিংসে বৃষ্টির কারণে ওভার কমে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে নতুন টার্গেট কি হবে এবং দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝ পথে বৃষ্টির কারণে ম্যাচ আর মাঠে না গড়ালেও এই পদ্ধতিতে ম্যাচের জয়-পরাজয় নির্ভুলভাবে বের করা যায়। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ